
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) এর একদল গবেষক বিশ্বে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স সম্পন্ন করেছে বলে দাবি করেছেন। তাদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি এন্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল আলমের নেতৃত্বে এ সফলতা আসে।
গবেষকদলের অন্য সদস্যরা হলেন— পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. বজলুর রহমান মোল্যা, বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শহিদুল ইসলাম ও ফিশারিজ বায়োলজি এন্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ গোলাম কাদের খান।
শনিবার সকাল ৯ টার দিকে বাকৃবি সাংবাদিক সমিতিতে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. সামছুল আলম।
অধ্যাপক ড. মো. সামছুল আলম বলেন, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর থেকে দুই বছর গবেষণার পর এ সাফল্য পেয়েছেন তারা। প্রথমে বঙ্গোপসাগর ও মেঘনা থেকে পূর্ণবয়স্ক ইলিশ মাছ সংগ্রহ করেন তারা। এরপর বাকৃবি ফিশ জেনেটিক্স এন্ড বায়োটেকনোলজি এবং পোল্ট্রি বায়োটেকনোলজি এন্ড জিনোমি ল্যাররেটরি থেকে সংগৃহীত ইলিশের উচ্চগুণগত মানের জিনোমিক ডিএনএ প্রস্তুত করা হয়। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের জিনউইজ জিনোম সিকোয়েন্সিং সেন্টার থেকে সংগৃহীত ইলিশের পৃথকভাবে প্রাথমিক জিনোম তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন সার্ভার কম্পিউটারে বিভিন্ন বায়োইনফরম্যাটিক্স প্রোগ্রাম ব্যবহার করে সংগৃহীত প্রাথমিক তথ্য থেকে ইলিশের পূর্ণাঙ্গ ডি-নোভো জিনোম সিকোয়েন্স বা জীবন রহস্য আবিষ্কার করা হয়। ইলিশের জিনোমে ৭৬ লক্ষ ৮০ হাজার নিউক্লিওটাইড রয়েছে যা মানুষের জিনোমের প্রায় এক চতুর্থাংশ। তবে পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে ইলিশের জিনোমে জিনের সংখ্যা জানার কাজ অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
বর্তমানে ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স জানার মাধ্যমে অসংখ্য অজানা প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে খুব সহজেই। বাংলাদেশের জলসীমার মধ্যে ইলিশের স্টকের সংখ্যা (একটি এলাকায় মাছের বিস্তৃতির পরিসীমা) কতটি এবং দেশের পদ্মা, মেঘনা নদীর মোহনায় প্রজননকারী ইলিশগুলো ভিন্ন ভিন্ন স্টক কিনা তা জানা যাবে এই জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে। বছরে দুইবার ইলিশ প্রজনন করে থাকে। জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে এই দুই সময়ের ইলিশ জিনগতভাবে পৃথক কিনা তা জানা যাবে। এমনকি কোনো নির্দিষ্ট নদীতে জন্ম নেয়া পোনা সাগরে যাওয়ার পর বড় হয়ে প্রজননের জন্য আবার একই নদীতেই ফিরে আসে কিনা সেসব তথ্যও জানা যাবে এই জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে।
ইলিশ মাছের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের প্রয়োজনীতা সম্পর্কে প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. মো. সামছুল আলম বলেন, ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। দেশে এর চাহিদার পাশাপাশি বিদেশেও চাহিদা রয়েছে প্রচুর। যেহেতু পৃথিবীর মোট ইলিশ উত্পাদনের প্রায় ষাট ভাগ উত্পন্ন হয় বাংলাদেশে, তাই দেশে ইলিশের উত্পাদন বাড়াতে পারলে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব। জীবের জন্ম, বৃদ্ধি, প্রজনন এবং পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াসহ সকল জৈবিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় জিনোম দ্বারা। আর এই পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স থেকেই জানা যাবে এরা কখন, কোথায় ডিম দেবে। আর এসব জানা গেলে সরকার খুব সহজেই বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে ইলিশের টেকসই আহরণ এবং উত্পাদন নিশ্চিত করতে পারবে।
তিনি আরও জানান, ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সের উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশীয় ইলিশের একটি রেফারেন্স জিনোম প্রস্তুত করা এবং জিনোমিক তথ্যভান্ডার স্থাপন করা। এই তথ্যভান্ডার ব্যবহার করে পরবর্তীতে গবেষকরা ইলিশের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করতে পারবেন। তবে ইলিশের সার্বিক উন্নয়নে পূর্নাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং বা জীবন রহস্য উদঘাটনের এই জ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ফলপ্রসূভাবে কাজে লাগাতে হলে এ বিষয়ে গবেষণা আরও জোরদার করতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা।
প্রসঙ্গত: ইলিশের পূর্ণাঙ্গ ডি-নোভো জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের গবেষণা কাজটি গবেষকবৃন্দের নিজস্ব উদ্যোগ, স্বেচ্ছাশ্রম এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সম্পন্ন করা হয়েছে। এ গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলদেশের মৎস্য সেক্টর পূর্ণাঙ্গ জিনোম গবেষণার যুগে প্রবেশ করল।