
আলু চাষ পদ্ধতি
চাষী সেবা ডেস্ক: আলু নিতান্তই শীতপ্রধান অঞ্চলের ফসল৷ নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলেও আলু ভালো জন্মে৷ তবে অ-নিরক্ষীয় অঞ্চলের শীতকালীন মৌসুমে যেমন আমাদের দেশে আলুর চাষ করা চলে৷ ১৬-২১ ডিগ্রি তাপমাত্রা আলুর জন্য আদর্শ স্থানীয়, তবে গাছ বৃদ্ধির প্রথম দিকে অধিক তাপ ও শেষ দিকে অর্থাৎ কন্দ ধরা কালীন সময়ে কম তাপ থাকা বাঞ্ছনীয়৷ কার্তিক-অগ্রহায়ণ ঋতুচক্রে হেমন্তকাল। তাই কার্তিক মাসের শুরুতেই শীতকালীন ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো শুরু করতে হয়। তার মধ্যে এ মাস আলু চাষের উপযুক্ত সময়। ফলে এখনই জেনে নিন আলু চাষের নিয়ম-কাননগুলো-
জমি তৈরি : আলুর জন্য জমি তৈরি ও বীজ বপনের উপযুক্ত সময় কার্তিক মাস। হালকা প্রকৃতির মাটি অর্থাৎ বেলে দো-আঁশ মাটি আলু চাষের জন্য বেশ উপযোগী। জমি ভালো ভাবে চাষ করে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হয়। PH ৫.৫-৬০ এর মধ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়, এতে আলুর জন্য ক্ষতিকর রোগ স্কেভিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না৷
জাত ও বীজ নির্বাচন: ভালো ফলনের জন্য বীজ আলু হিসেবে ডায়মন্ড, মুল্টা, কার্ডিনাল, প্যাট্রেনিজ, হীরা, মরিন, অরিগো, আইলশা, ক্লিওপেট্রা, গ্রানোলা, বিনেলা, কুফরিসুন্দরী উল্লেখযোগ্য। প্রতি হেক্টর জমি আবাদ করতে ১৫০০ থেকে ২০০০ কেজি বীজ আলু দরকার।
বীজ বপন পূর্বে করণীয় : বীজ প্রত্যয়িত হলে বপনের আগে আর কোনো রকম ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন হয় না৷ অন্যথায় বীজ শোধন করে নেওয়া ভালো৷ বীজ শোধনের জন্য মারকিউরিক ক্লোরাইড (Mercuric chloride), ফার্মালডিহাইড (Formaldehyde) অথবা, ইয়েলো অক্সাইড অব মার্কারি (Yellow oxide of mercury) ব্যবহার করা যায়৷ উক্ত তরল গুলোতে আলুর বীজকে কিছুক্ষণ চুবিয়ে উঠিয়ে নিলেই বীজ শোধন হয়ে যায়৷ তবে কাটা বীজ ব্যবহার করতে গেলে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, যেমন-
- বীজ কাটার সময় ধারালো ছুড়ি দিয়ে লম্বালম্বি কাটতে হবে।
- বীজের কাটা দিকটায় পরিষ্কার ঠাণ্ডা ছাই লাগিয়ে দিতে হবে৷ এই সমস্ত সাবধানতা অবলম্বন করলে বীজ পচে নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা কম থাকবে৷
- কাটা বীজ আলুকে কিউরিং করে নিলেও উপকার পাওয়া যায়৷ কিউরিংয়ের জন্য কর্তিত বীজ আলুকে ৬০-৭০ডিগ্রি ফারেনহাইট অর্থাৎ ১৬-২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ও ৮৫-ঌ০% আদ্রতায় সপ্তাহ খানেক রাখলে বীজের কর্তিত তলে একটি আত্নরক্ষাকারী স্তর সৃষ্টি হয় যা বীজের মধ্যে রোগজীবাণুর প্রবেশ অনেকাংশে রোধ করতে পারে৷ তবে এইভাবে কিউরিং করা সাধারণ চাষীদের পক্ষে সম্ভব না হলেও বীজ আলুকে পাতলা স্তরে মেঝেতে ছড়িয়ে ভিজা চট দ্বারা কয়েকদিন ঢেকে রাখলে সুফল পাওয়া যাবে৷
সারিতে দুই পদ্ধতিতে বীজ বপন করা যায়:
- প্রথম পদ্ধতিতে প্রতি সারি বরাবর ৫-৭ সেন্টিমিটার মাটি সরিয়ে নিয়ে নালা প্রস্তুত করা হয়, তারপর সেই নালাতে নির্দিষ্ট দূরত্বে বীজ বপন করে মাটি দ্বারা বীজ ঢেকে দেওয়া হয়৷
- দ্বিতীয় পদ্ধতিতে সারির মাটি না খুড়ে অর্থাৎ নালা না করে সারির দাগ বরাবর বীজ নির্দিষ্ট ব্যবধানে বপন করার পর দুই সারির মধ্যবর্তী জায়গা হতে মাটি টেনে উঁচু করে বীজ ঢেকে দেওয়া হয়৷
শেষোক্ত পদ্ধতিটিই বিজ্ঞানসম্মত, কেননা এতে জমির রস অধিক দিন বজায় থাকে এবং সারির মাটি আলগা থাকে বলে আলুর কন্দ বৃদ্ধিতে কোনো বাধার সৃষ্টি হয় না৷ অন্য দিকে প্রথমোক্ত পদ্ধতিতে নালার মাটি চাপ খাওয়া থাকে বলে স্কন্দের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়৷ ফলে কন্দ অর্থাৎ আলুর আকার ছোট থেকে যায়৷
বীজ হার : বপনের জন্য প্রতি হেক্টরে সাধারণত ১৫০০-২০০০ কেজি বীজ লাগে৷ তবে বীজ আকারে বড় হলে কিছু বেশি এবং ছোট হলে কিছু কম লাগে৷ বপন দূরত্ব : রোপণের দূরত্ব ৬০ -২৫ সেন্টিমিটার (আস্ত আলু) এবং ৪৫-১৫ সেন্টিমিটার (কাটা আলু)৷
সার ব্যবস্থাপনা
সারের পরিমাণ: আলু চাষে নিচে উল্লেখিত হারে সার ব্যবহার করা প্রয়োজন৷
সারের নাম সারের পরিমাণ/হেক্টর সারের পরিমাণ/শতাংশ
ইউরিয়া ২২০ – ২৫০ কেজি ঌ০০ গ্রাম – ১ কেজি
টিএসপি ১২০ – ১৫০ কেজি ৫০০ – ৬০০ গ্রাম
এমপি ২২০ – ২৫০ কেজি ঌ০০ গ্রাম – ১ কেজি
জিপসাম ১০০ – ১২০ কেজি ৪০০ – ৫০০ গ্রাম
জিঙ্ক সালফেট ৮ – ১০ কেজি ৩০ -৪০ গ্রাম
ম্যাগনেসিয়াম সালফেট
(অম্লীয় বেলে মাটির জন্য) ৮০ – ১০০ কেজি ৩০০ -৪০০ গ্রাম
বোরন (বেলে মাটির জন্য) ৮ – ১০ কেজি ৩০ -৪০ গ্রাম
গোবর সার ৮ – ১০ টন ৩০ -৪০ টন
সাধারণত এক হেক্টর জমিতে আলু আবাদ করতে ৩২৫ কেজি ইউরিয়া, ২২০ কেজি টিএসপি, ২৫০ কেজি এমওপি, ১৫০ কেজি জিপসাম এবং ১৪ কেজি দস্তা সার প্রয়োজন। তবে এ সারের পরিমাণ জমির অবস্থাভেদে কম-বেশি হতে পারে। তাছাড়া হেক্টরপ্রতি ১০-১২ টন জৈব সার ব্যবহার করলে ফলন অনেক বেশি হয়।
পরিচর্যা: আলু উৎপাদনে আগাছা পরিষ্কার, সেচ, সারের উপরি প্রয়োগ, মাটি আলগাকরণ বা কেলিতে মাটি তুলে দেওয়া, বালাই দমন, মালচিং করা আবশ্যক। সময়মতো সবগুলো কাজ করতে পারলে খরচ কমে আসে, ফলন বেশি হয়। চারা গাছের উচ্চতা ১০-১৫ সেন্টিমিটার হলে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। দুই সারির মাঝে সার দিয়ে কোদালের সাহায্যে মাটি কুপিয়ে গাছের গোড়ায় তুলে দিতে হবে। ১০-১২ দিন পরপর এভাবে গাছের গোড়ায় মাটি তুলে না দিলে ভালো হয়।
রোগ দমন: আলু ফসলে নাবি ধসা রোগ দেখা দিতে পারে। মড়ক রোগ দমনে ২ গ্রাম ডায়থেন এম ৪৫ অথবা সিকিউর অথবা ইন্ডোফিল প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ৭ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে। মড়ক লাগা জমিতে সেচ দেওয়া বন্ধ রাখতে হবে। তাছাড়া আলু ফসলে মালচিং, সেচ প্রয়োগ, আগাছা দমনের কাজগুলোও করতে হবে। গাছের বয়স ৯০ দিন হলে মাটির সমান করে গাছ কেটে ১০ দিন পর আলু তুলে ফেলতে হবে। আলু তোলার পর ভালো করে শুকিয়ে বাছাই করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা
গাছের গোড়ায় মাটি দেওয়া : আলু লাগানোর ৩০-৩৫ দিন পর গোড়ায় মাটি দেওয়া প্রয়োজন৷ জমিতে আলুর গাছ যখন ৫-৬ ইঞ্চি অর্থাৎ ১২-১৫ সেন্টিমিটার হয় তখন দুই সারির মাঝখানের মাটি হালকাভাবে কুপিয়ে নরম ঝুরঝুরা করে নিতে হয়৷ এই সময় জমির আগাছা নিধনের কাজও হয়ে যায়৷ নরম ঝুরঝুরা মাটি কোদালি দ্বারা টেনে সারিতে গাছের দুই দিকে দেওয়া হয়৷ এর তিন সপ্তাহ পর গোড়ায় আবার মাটি দিতে হয়৷ গাছের বৃদ্ধি বেশি হলে আর একবার অর্থাৎ তৃতীয়বারের মতো মাটি দেওয়া হয়৷ গাছের গোড়ায় এইভাবে মাটি দিলে গাছের স্টোলনগুলো টিউবার অর্থাৎ আলুতে পরিণত হবার সুযোগ পায়৷ মাটি ঠিকমতো দেওয়া না হলে বর্ধিষ্ণু আলু মাটির বাইরে এসে সবুজ রং ধারণ করে৷ এ রকম আলু খাবার অনুপোযোগী এবং কখনো কখনো তা বিষাক্তও হতে পারে৷
পরিপক্বতার লক্ষণ
- যখন দেখা যাবে আলু গাছগুলো হলুদ হয়ে মরে যাচ্ছে তখনই বুঝতে হবে আলু তোলার উপযুক্ত সময় হয়েছে৷
- সাধারণত আলুবীজ লাগাবার ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যেই এ আলু তোলা যায়৷
আলু সংগ্রহ : আলুর সারিতে কোদালের সাহয্যে বা লাঙল চালিয়ে আলু মাটি থেকে তোলা হয়৷ তবে আলু তোলার সময় সতর্ক থাকতে হবে যাতে আলু কেটে বা থেতলিয়ে না যায়, কেননা আলু থেতলিয়ে গেলে সংরক্ষণ করার সময় পচে যায়৷