
পৃথিবী তথ্য প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়েছে। বিশেষ করে ইন্টারনেট প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমরা ৩য় প্রজন্মের যোগাযোগ প্রযুক্তি পেরিয়ে ৪র্থ প্রজন্মের প্রযুক্তির গ্রহণের প্রহর গুনছি। হালনাগাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরাও পিছিয়ে নেই। সি৩ রাইস বাদ দিয়ে ধানের উৎপাদন দ্বিগুণ বা তারও বেশি করার লক্ষ্যে এবার বিজ্ঞানীরা সি৪ রাইস উদ্ভাবনে দিকে এগুচ্ছেন। শুধু এগুচ্ছেন বললে ভুল হবে, ২০০৮ সালে বিশ্বের ৮টি দেশের ১২টি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে গঠিত সি৪ রাইস গবেষণা কনসোর্টিয়াম সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন তারা সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে অনেকদূর এগিয়ে গেছেন। অগ্রগতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পুর্বে আসুন জেনে নেয়া যাক সি৪ ধান আসলে কি?
সি৪ রাইস কি:
সি৪ রাইস বলতে এমন একটি ধানকে বোঝানো হয়ে থাকে যেটির পাতায় ক্রাঞ্জ এনাটমি (Kranz Anatomy) বিদ্যমান থাকার কারণে খাদ্য তৈরীর জন্য সি৪ সালোকসংশ্লেষণিক ধাপ অনুসরণ করবে। Kran একটি জার্মান শব্দ যার অর্থ ফুলের তোড়ার ন্যায় সাজানো ব্যবস্থা। এই পৃথিবীতে ৮৫ভাগ উদ্ভিদে সি৩ সালোকসংশ্লেষণিক চক্র বিদ্যামান থাকলেও ৫ ভাগ উদ্ভিদে সি৪ সালোকসংশ্লেষণিক চক্র এবং বাকী ১০ ভাগ উদ্ভিদে CAM সালোকসংশ্লেষণিক চক্র (মরু উদ্ভিদ) বিদ্যামান। সবুজ উদ্ভিদ সাধারণত সূর্যালোকের উপস্থিতিতে সালোকসংশ্লেষণ নামক জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবেশ থেকে সংগৃহীত কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2) ও মূল দ্বারা শোষিত পানির বিক্রিয়ার মাধ্যমে শর্করা জাতীয় খাদ্য তৈরি করে তা শস্য বা বীজে সঞ্চয় করে। এই প্রক্রিয়ায় সজীব উদ্ভিদ কোষে উপস্থিত ক্লোরোফিল নামক রঞ্জক আলোকশক্তিকে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে এবং উৎপন্ন শর্করা শস্য বীজের মধ্যে স্থিতিশক্তি রূপে সঞ্চিত থাকে। শক্তির এই রূপান্তর দক্ষতা যে উদ্ভিদের যত বেশি সে উদ্ভিদের ফলনও তত বেশি হয়ে থাকে। উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে উৎপন্ন খাদ্য পাতা, শিকড়, ডাল ও ফুল বিকাশের জন্য ব্যবহার করে বাকি অংশ দানা বা শস্যে জমা রাখে যা আমরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করি। কন্দ জাতীয় ফসল আলু-কচুর বেলায় এই জমাটা হয় মাটির নিচে। আখের বেলায় পুরো শরীর জুড়ে। খাদ্য গ্রহনের পর এতে সঞ্চিত শক্তি পরবর্তীকালে প্রাণীদের গৌণ পুষ্টিতে পরিণত হয়। আলোকশক্তিকে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত করার দক্ষতা সি৩ ফসলের তুলনায় সি৪ উদ্ভিদের বেশি হয়ে থাকে। যে কারণে ধানের তুলনায় গম, সরগম ও ভূট্টার ফলন বেশি হয়ে থাকে।
আমরা যদি সি৪ রাইসে বিজ্ঞান বুঝতে চাই, প্রথমেই আমাদের বুঝতে হবে ধান আসলে একটি সি৩ উদ্ভিদ। এখানে সালোকসংশ্লেষণের সময় (CO2) গ্যাস রাইবুলোজ-বাইফসফেট কার্বক্সিলেজ অক্সিজিলেজ (RuBisCo) এনজাইমের সাহায্যে প্রথমে তিন কার্বন বিশিষ্ট্য একটি যৌগের সাথে যুক্ত হয়। কিন্তু তাপমাত্রা যদি 200c এর বেশি হয় সেক্ষেত্রে এই এনজাইমের (CO2) এর সাথে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা কমতে থাকে। সেই সাথে এটা অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করতে থাকে, যা ফটোরেসপিরেশন হিসেবে পরিচিত।
উল্লেখ্য, এই ফটোরেসপিরেশন একটি অপচয় প্রক্রিয়া যা সালোকসংশ্লেষণের দক্ষতা কমিয়ে দেয়। অন্য দিকে সি৪ উদ্ভিদের বান্ডল সীথে ক্রাঞ্জ এনাটমি থাকার করণে গরম ও শুষ্ক আবহাওয়াতেও এটি ভালোমতো (CO2) এর সাথে যুক্ত হয়। অর্থাৎ এতে ফটোরেসপিরেশন কম হয় যা পরে ৩০-৫০ভাগ ফলন বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া সি৪ উদ্ভিদ পানি সাশ্রয়ী। কারণ দিনের উষ্ণতম সময়ে এই উদ্ভিদের পত্ররন্ধ্র বন্ধ থাকে। অধিকন্তু এই উদ্ভিদ নাইট্রজেন ব্যবহারে সাশ্রয়ী। কারণ সমপরিমান কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস যুক্ত করার জন্য এই উদ্ভিদ কম RuBisCo এনজাইম ব্যবহার করে। এনজাইমগুলো আসলে প্রোটিন যার ১৫ভাগ নাইট্রোজেন (N) হওয়ায়, সি৪ উদ্ভিদে তুলনামুলক কম নাইট্রোজেন প্রয়োগ প্রয়োজন হয়।
ধানে সি৩ সালোকসংশ্লেষণিক ধাপ বিদ্যমান থাকে কিন্তু ভূট্টাতে অধিক কার্যকরী সি৪ সালোকসংশ্লেষণিক ধাপ রয়েছে। ধান গাছকে সি৩ থেকে সি৪-এ রূপান্তরের জন্য পাতার অভ্যন্তরে অবস্থিত কোষসমূহকে এমনভাবে পূণর্বিন্যাস করা প্রয়োজন যেখানে ধান গাছে বিদ্যমান সি৪ ধাপের সকল নিষ্ক্রিয় উপাদানসমূহ সক্রিয় হয়। ফলে সি৪ সালোকসংশ্লেষণিক ধাপের সাথে জড়িত সকল এনজাইমসমূহের অধিকতর প্রকাশ ঘটবে বিধায় ধান গাছ আগের তুলনায় অধিক শর্করা তৈরী করতে সক্ষম হবে। সি৪ সালোকসংশ্লেষণের সমস্ত উপাদান ধান গাছে রয়েছে কিন্তু এগুলোর বিন্যাস ও কোষের গঠন ভিন্নতার কারণে ধানে সক্রিয় সি৪ সালোকসংশ্লেসন হয়না। তাই প্রাকৃতিক বিবর্তন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ধানকে সি৩ থেকে সি৪ উদ্ভিদে রূপান্তরিত করে পাতাগুলির মধ্যে সেলুলার স্ট্রাকচারগুলির পুনঃর্গঠন এবং সালোকসংশ্লেষণের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সি৪ উদ্ভিদের ন্যায় সূর্যালোক ব্যবহারে ধানের বিভিন্ন এনজাইমের আরও কার্যকর করাই গবেষণার অন্যতম লক্ষ্য।
সি৪ সালোকসংশ্লেষণ কি:
ধানসহ বেশিরভাগ উদ্ভিদের মধ্যে সালোকসংশ্লেষণ এনজাইম রাইবোলজ বিসফসফেট কারবক্সিলেজ অক্সিজেনেস বা সংক্ষেপে রুবিস্কো এনজাইমের মাধ্যমে CO2 সংশ্লেষণের মাধ্যমে গঠিত প্রথম যৌগটি তিন কার্বন বিশিষ্ট হয়ে থাকে। এজন্য এটি সি৩ সালোকসংশ্লেষণ নামে পরিচিত। রুবিস্কো প্রকৃতিগতভাবে শক্তির রপান্তরে অদক্ষ কেননা এটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া বা একটি অপচয়মূলক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে যা ফটোরেসপিরেশন হিসাবে পরিচিত। পরিবেশের তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের উপরে হলে, শর্করায় CO2 ফিক্সেশন অক্সিজেন (O2) দ্বারা প্রতিযোগিতার সম্মুখিন হয়, যা সালোকসংশ্লেষণের দক্ষতাকে নাটকীয়ভাবে হ্রাস করে। কারণ হলো-ফটোরেসইপরেশন বা শ্বসনের ফলে উদ্ভিদের পাতার পানি উদ্বায়নের মাধ্যমে বায়ুমন্ডলে চলে যায়, যখন CO2 ফিক্সেশনও বাঁধাগ্রস্ত হয়। এই কারণে, গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চল যেখানে বিশ্বের বেশিরভাগ ধান উৎপাদিত হয় সেখানে সালোকসংশ্লেষণের দক্ষতা বাঁধাগ্রস্ত হয়। অপরপক্ষে O2 উদ্ভিদগুলি কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ফিক্সেশনের ক্ষেত্রে অধিক দক্ষ হয়, যার ফলে পানি এবং নাইট্রোজেন ব্যবহারের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং অপেক্ষাকৃত গরম ও শুস্ক পরিবেশে উদ্ভিদ সহজে অভিযোজনে সক্ষম হয়। প্রকৃতিতে, এটি ৫০টির অধিক উদ্ভিদে ঘটে থাকে, যা ইঙ্গিত করে যে জটিল হওয়ার সত্ত্বেও এটি সালোকসংশ্লেষণের অপেক্ষাকৃত দক্ষ প্রক্রিয়া।
সি৪ রাইস কেন প্রয়োজন:
অতি প্রাচীনকাল থেকে কৃষি মানব সমাজের অপরিহার্য ভিত্তি। আর মাটি, পানি, জলবায়ু ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা দ্বারা কৃষির প্রকৃতি ও উৎপাদনশীলতা নির্ধারিত হয়। ভূপৃষ্ঠের মাত্র ২৯ ভাগ স্থল ভূমি এবং বাকি ৭১ ভাগ জলভূমি। আবার ২৯ ভাগ স্থল ভূমির মধ্যে কৃষির জন্য উপযুক্ত এক তৃতীয়াংশ মাত্র। বাকিটা বরফ, মরুভূমি, বনভূমি এবং চাষের জন্য অনুপযুক্ত অনাবাদি জমি। আরো সহজভাবে বলতে গেলে ভূ-পৃষ্ঠের মাত্র ১০ভাগ ভূমি বিশ্বের ৬.৬ বিলিয়ন মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য যোগান দিয়ে থাকে। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় এক বিলিয়ন মানুষের দৈনিক আয় এক ডলারের কম, যা তাদের দৈনন্দিন খাদ্য খরচের অর্ধেক মাত্র। বিশ্বের ৮৫৪ মিলিয়ন মানুষ এখনো ক্ষুধার্ত দিন যাপন করে এবং প্রতিদিন প্রায় ২৫,০০০ মানুষ ক্ষুধার কারণে মৃত্যু বরণ করে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৬০ ভাগ এশিয়া অঞ্চলে বসবাস করে, যেখানে বর্তমানে ধান উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত প্রতি হেক্টর জমি ২৭ জন মানুষকে খাদ্য সরবরাহ করে, কিন্তু ২০৫০ সালের মধ্যে একই জমি থেকে কমপক্ষে ৪৩ জন মানুষকে খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। তাছাড়া শিল্পায়ন ও নগরায়নের কারণে আবাদি জমি ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। ভবিষ্যতে বিশ্বের জনসংখ্যার ৭৫ভাগ শহরে বসবাস করবে তাদের জন্য অবিরত খাদ্য সরবারাহ বজায় রাখা বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়াবে। এই প্রেক্ষাপটে ধানের বর্তমান ফলন সীমা অতিক্রম করার জন্য সি৩ রাইস কে সি৪ রাইসে রূপান্তর করা ধান বিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন ধান বিজ্ঞানীরা
ইরির সি৪ (C4) ধান প্রকল্পের ইতিকথা
সি৪ ধান উদ্ভাবনের প্রস্তাবটি সর্বপ্রথম ড. জন সিহির ১৯৯৫ সালে করেন, যিনি ইরিতে একজন উদ্ভিদ শারীরতও¦বীদ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তবে প্রকৃত গবেষণার কাজ শুরু হয় ২০০৮, সালে যখন বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ঈ৪ ধান গবেষণায় ১১.১ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেন। বর্তমানে (C4) ধান প্রকল্পটি তৃতীয় পর্যায়ে (২০১৫-২০১৯) আছে এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জেন ল্যাংডেল এই গবেষণার সমন্বয় করছেন। এই প্রকল্পে আটটি দেশের ১২টি প্রতিষ্ঠানের সর্বমোট ১৮ টি রিসার্চ গ্রুপের বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা যুক্ত আছেন। এ পর্যন্ত গবেষণার অগ্রগতি হচ্ছে ধানের পাতায় একটি জিন (GOLDEN ২ এর মত জিন) প্রবেশ করানো সম্ভব হয়েছে। ফলে প্রোটো-ক্রাঞ্জ এনাটমি পাওয়া গেছে যা ঈ৩ ধান হতে সি৪ রাইসে রূপান্তরের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। ২০৩৫ সালের মধ্যে এশিয়ার ১৩টি দেশে ট্রান্সজেনিক সি৪ রাইস ছাড়করণ করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা। এর জন্য গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের জন্য ১০৬ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার এবং ছাড়করণ সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণ-মূলক কর্মকান্ডের জন্য ১৮.৮ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার প্রয়োজন হবে।
C4 ধানের সুবিধা ও সম্ভাবনা
সি৪ সালোকসংশ্লেষণ প্রযুক্তি সি-৩ ধানে প্রতিস্থাপন বা সংযোজন করা গেলে ধানের উৎপাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া দিনের অপেক্ষাকৃত গরম অংশে ধানের পাতার পত্ররন্দ্র আশিংক বন্ধ থাকার ফলে পানির অপচয় কম হবে। ধানের পানির ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধির ফলে গম, ভূট্টা, আখের ন্যায় ধান চাষে সেচ চাহিদা বর্তমানের চেয়ে অর্ধেকে নেমে আসবে এবং প্রতি একক পানি অপচয়ের বিপরীতে বেশি পরিমাণে CO2 ফিক্সেশন হবে। ধান চাষে সারের ব্যবহার বর্তমানের চেয়ে অর্ধেকে নেমে আসবে। সি৪ রাইসের নাইট্্েরাজেন ব্যবহারের দক্ষতা ৩০ ভাগ বেশি হবে কারণ শর্করায় CO2 ফিক্সেশনকারী এনজাইমের প্রয়োজনীতা হ্রাস পাবে। এই সমস্ত কারণে বর্তমান ধানের তুলনায় সি৪ ধানের ফলন ৩০ থেকে ৪০ভাগ বেড়ে যাবে। এটি ব্যাতিত অন্য কোন বিবর্তনমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধানে এই ধরণের ইতিবাচক রুপান্তর ও উন্নয়ন সম্ভব নয়।
লেখক-সিনিয়র লিয়াজোঁ অফিসার, ব্রি, গাজীপুর।