
আব্দুল্লাহ আল নোমান, টাঙ্গাইল সংবাদদাতা: সৌদি আরবে দুই দুই বছর কাজ করে ২০১৯ এর শেষে দিকে তিন মাসের ছুটিতে আসেন টাঙ্গাইলের বাসাইলের সাইফুল ইসলাম (৩০)। ছুটি কাটিয়ে আবারো সৌদি যাবার সময় দেশে পুরোদমে করোনা ভাইরাসের কারণে লকডাউনে আটকে যায় সে। এদিকে ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে যায়।
একদিকে সংসারের খরচ অপর দিকে বিদেশ যাবার সময়ের ধার-দেনা এসব মিলিয়ে অন্ধকার নেমে আসে তার জীবনে। একটা কর্মসংস্থানের আশার দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। পরে তিনি কৃষি অফিসের পরামশ মতে মাশরুম চাষের পরিকল্পনা করেন। মাশরুম চাষে সাইফুল তার অন্ধকার জীবনে আলো জ্বালিয়েছে। সাইফুল ইসলামের বাড়ি বাসাইল সদর ইউনিয়নের রাশড়া গ্রামে।
সাইফুল ইসলাম বলেন, ২০০০ সালে ব্র্যাক স্কুল প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে নানির বাড়ি পাশ্ববর্তি উপজেলার মির্জাপুর বাঁশতৈল উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে ভর্তী হন। ২০০৪ দশম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর লেখা পড়ায় আর তার মনে বসে না। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় ৪ বছর অপচয় করেন। নিজ ইচ্ছা না থাকা সত্তে¡ও পরিবারের সদস্যদের পরামর্শে ২০০৮ সালে তিনি ডুবাই চলে যান। সেখানে দুই বছর কাজ করে ২০১০ সালে ছুটিতে বাড়ি এসে বিয়ে করেন। বিয়ে করে আবার তিনি ডুবাই যান।
সেখানে আরও দুই বছর থেকে ২০১২ সালে বাড়ি চলে আসেন। কিছুদিন বেকার থাকার পর সিঙ্গাপুর যাওয়ার জন্য ২০১৩ সালে ইলেকট্রিক্যাল বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন। ৮ লাখ টাকা খরচ করে ২০১৫ সালে সিঙ্গাপুর যান। এক বছর থেকেই ২০১৬ সালে চলে আসেন। দুই সন্তান রেখে জীবিকার তাগিদে ২০১৮ সালে সৌদিআরব যান। দুই বছর কাজ করে ২০১৯ এর শেষে দিকে তিন মাসের ছুটিতে আসেন। ছুটি কাটিয়ে আবারো সৌদি যাবার সময় দেশে পুরোদমে লকডাউনে আটকে যায় সে। এদিকে ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। একদিকে সংসারের খরচ অপর দিকে বিদেশ যাবার সময়ের ধার-দেনা এসব মিলিয়ে অন্ধকার নেমে আসে তার জীবনে।
একটা কর্মসংস্থানের আশার দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। পরে তিনি কৃষির উপরই কিছু করবেন বলে মনস্থির করেন। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে পরামর্শ নিয়ে সাভার জাতীয় মাশরুম ইনষ্টিটিউটে যোগাযোগ করেন এবং করোনাকালীন সময়ে মোবাইলে ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে জুম সিটিং আইডি’র মাধ্যমে ১০ দিনব্যাপি একটি অনলাইন প্রশিক্ষন নেন। এরপর আরো ৭ দিন সাভারে হাতে কলমে বাস্তবমুখী অভিজ্ঞতা শেষে ওখান থেকে বীজ নিয়ে আসেন।
তিনি বলেন, মাশরুমের তৈরী বিভিন্ন খাবারের সমন্বয়ে একটি ফাষ্টফুডের দোকান। মাশরুমের চাষ করে এখন সে প্রতিদিন প্রবাস জীবনের চেয়েও বেশি উপার্জন করছে। পুনঃরায় সৌদিআরব যেতে না পেরে স্ত্রী-কন্যা এবং পরিবারের চিন্তা যখন তার জীবনকে ক্রমাগত অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছিলো তখন বাসাইল উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে মাশরুম চাষের বিষয়ে উৎসাহিত হয়ে উঠেন।
২০২০ সালের ফেব্রæয়ারিতে নিজের বসত ঘরের পাশে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যায়ে ২০ হাত একটি ঘর নির্মান করেন। ১২/১৫ টাকা দরে ৩শ’ ৫০টি স্পুন (কাঠের ভূষি,ধানের তুষ,চুন দিয়ে তৈরি) এবং খড়ের (ধানের খড় দিয়ে তৈরি) প্যাকেটের বীজ নিয়ে মাশরুম চাষ শুরু করেন তিনি। মাত্র ৩০ দিন পর থেকেই মাশরুম সংগ্রহ শুরু হয় যা প্রতি সপ্তাহে একবার করে পর্যায়ক্রমে আড়াই মাস পর্যন্ত সংগ্রহ করা যায়। খামারের ফ্লোরে রাখা প্রতিটি স্পুন প্যাকেট থেকে ২৫০ গ্রাম এবং ঝুলিয়ে রাখা খড়ের প্যাকেট থেকে ৫০০ গ্রাম করে মাশরুম পাওয়া যায় প্রতিবার। এভাবে ৩শ’ ৫০টি বীজ থেকে প্রতিবার ৫/৬ কেজি করে মাশরুম সংগ্রহ করা যায়। বর্তমানে সাইফুলের খামারে মাশরুম সংগ্রহের মতন প্রায় ৭শ’ প্যাকেট রয়েছে।
সাইফুল ইসলাম বলেন, লক্ষ ঠিক করে সৎ সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলে যেকোন কাজে সফল হওয়া সম্ভব। প্রবাসের বেকারত্বের অন্ধকার জীবন থেকে মাশরুমের খামার আমাকে আলোর পথ দেখিয়েছে। মাশরুমের খামার এবং মাশরুম ফাষ্টফুড বিক্রি করে প্রতিদিন প্রায় হাজার টাকা উপার্জন করছি। ১২/১৫ টাকার একটি খরের প্যাকেটের বীজ থেকে ৭৫ থেকে ৯০ দিনে তিন থেকে চার কেজি মাশরুম সংগ্রহ করা যায়। বাজারে যার খুচরা মূল্য দুইশ’ টাকা প্রতি কেজি। বাসাইলে মাশরুমের যে পরিমান চাহিদা রয়েছে সেটা আমি একা পূরন করতে পারিনা। আশা করছি দুই হাজার প্যাকেট বীজ নিয়ে চাষ করতে পারলে এই চাহিদা পূরন সম্ভব হবে। আর্থিক সংকটের কারনে আমি খামার বৃদ্ধি করতে এবং একটি মাশরুম ল্যাব প্রতিষ্ঠা করতে পারছিনা। সরকারী সহায়তা পেলে বাসাইলে একটি মাশরুম বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।
এ ব্যাপারে বাসাইল উপজেলা কৃষি সম্প্রসারন কর্মকর্তা নাজনীন আক্তার বলেন, মাশরুম একটি উপকারী, স্বাস্থ্যসন্মত খাবার। মাশরুম দিয়ে সাবান, পাউডার, স্যুপ, চপসহ বিভিন্ন উপাদেয় খাবার তৈরি করা যায়। আমাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে সাভারে প্রশিক্ষণ শেষে সাইফুল ইসলাম মাশরুম খামার করেছে এবং দুই থেকে আড়াইমাস পর প্রতিদিন ৫/৬ কেজি মাশরুম উৎপাদন করতে পারছেন। যেকোন পরামর্শে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সব সময়ই তার পাশে থাকবে। বাসাইলের বেকার যুবকদের জন্য সাইফুল অনুকরণীয়। তাকে দেখে বেকার যুবকরা মাশরুম চাষে আগ্রহী হয়ে প্রশিক্ষন নিতে চাইলে তাদেরকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।