
টাঙ্গাইল সংবাদদাতা: টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে শীতের হিমেল বাতাস বইতে না বইতেই গুড় তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন আখ চাষীরা। আর শীতের মৌসুম এলেই শুরু হয়ে যায় সুস্বাদু আখের গুড় তৈরির কাজ। একদিকে আখ কেটে সংগ্রহ করা হচ্ছে, অন্যদিকে কেটে আনা আখ থেকে মেশিনের মাধ্যমে রস সংগ্রহ করে সেই রস জাল দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে গুড়।
জানা যায়, শীত মানেই বাঙ্গালীর পিঠা-পুলির উৎসব। যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীর তীরবর্তী গ্রাম চরহামজানী। কালিহাতী উপজেলার দূর্গাপুর ইউনিয়নে প্রত্যন্ত চরা লের ভিতরে এই গ্রামটি আখের গুড় তৈরির গ্রাম হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকায় প্রতি শীত মৌসুমে আখ থেকে গুড় তৈরি করতে দেখা যায়। তবে আগের মত আখ চাষ না থাকায় তেমন একটা চোখে পড়ে না রস থেকে গুড় তৈরি করার দৃশ্য।
সরেজমিন দেখা যায়, গ্রামের নারী-পুরষ, কিশোররা আখ থেকে পাতা ও আগা বাদ দিয়ে শুধু আখ বের করে আলাদা করে রাখছেন। আর পাতা ও আগার অংশটুক নিয়ে যাচ্ছে বাড়িতে গৃহ পালিত পশু গরু-ছাগলের খাবার হিসেবে। তারপর সেই আখ গুলো থেকে কারিগররা একটি মেশিনের মাধ্যমে রস বের করছে। তার পাশেই পরপর দু’টি বিশাল উনুন তৈরি করে তার উপর চাপানো হয়েছে বিশাল মাপের লোহার কড়াই। তাতেই আখের রস ঢেলে জ্বাল দিচ্ছে। আর অনবরত সেই কড়াইয়ের দিকে সজাগ নজর গুড় কারিগরদের। এসময় কারিগররা প্রায় ২ থেকে ৩ ঘণ্টা রস জ্বাল করে। পরে তা চুলা থেকে নামিয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট রাখার পর শক্ত হয়। পরে কারিগরদের হাতের সাহায্যে শক্ত গুড় গুলোকে একটি নিদিষ্ট আকার দেওয়া হয়। এভাবেই তৈরি করা হয় আখের রস থেকে সুস্বাদু গুড়।
জেলা কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে টাঙ্গাইলের ১০টি উপজেলায় ৪৭৯ হেক্টর জমিতে আখের চাষ হয়েছে। কিন্তু বন্যার কারনে এ বছর আখ চাষীদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
আখের গুড় তৈরির কারিগর রেজাউল করিম বলেন, আমিসহ আরো ৫ থেকে ৬ জন সিরাজগঞ্জ জেলা থেকে এ জেলায় কাজ করতে আসছি। আমি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে এই পেশায় আছি। শীত মৌসুমের শুরু থেকেই আমরা মহাজনের সাথে যোগাযোগ করে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকায় আখের রস থেকে গুড় বানানোর কাজ করি। আখ কাটা থেকে শুরু করে গুড় তৈরি পর্যন্ত প্রায় ২০ থেকে ২৫ দিন এখানে থাকতে হয়। এরপর আবার অন্য এলাকায় আখ থেকে গুড় তৈরির জন্য যাবো। এভাবেই শীতের সময় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে কাজ করতে হয়। আর প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ কড়াই গুড় তৈরি করি। পারিশ্রমিক হিসেবে কড়াই প্রতি ৩শ’ টাকা করে পাই। এতে করে কোন রকম ডাল-ভাত খেতে পারি।
গুড় তৈরির কারিগর আবদুল হাই, রহমত আলী, জহুরুল ইসলাম ও অহেজ উদ্দিন বলেন, আমরা প্রতি বছর টাঙ্গাইল জেলার যেসকল এলাকায় আখ চাষ হয় সে সকল এলাকায় গিয়ে আখের রস থেকে গুড় তৈরির কাজ করি। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত প্রায় ৭ থেকে ৮ কড়াই গুড় তৈরি করতে পারি। প্রতি কড়াই থেকে প্রায় ৬০ কেজি করে গুড় তৈরি করা যায়। আর আমাদের কাজের মান অনুযায়ী আমরা প্রারিশ্রমিক পাই। তবে বিগত বছর গুলোর তুলনায় এ বছর আখের চাষ কম হওয়ায় আমাদের কাজও কম। বছরের ৬ মাস এ পেশার সাথে থাকি। বাকি দিনগুলো নিজ জেলায় কৃষি কাজ করে জীর্বিকা নিবাহ করি।
এলাকাবাসী জানায়, আমাদের বাড়িতে গৃহ পালিত পশুর জন্য প্রচুর পরিমানে খাদ্য সংগ্রহ করতে হয়। আর এই শীত মৌসুমে আমরা আখের পাতা ও আগার অংশ কেটে নিয়ে আসি। এতে করে আখ চাষীদেরও লাভ হয় এবং আমরা গরু-ছাগলের জন্য খাদ্য পেয়ে যাই।
আখ ক্ষেতের মালিকরা বলেন, চরা চলে এক মৌসুমের ফসল চাষ করার পর আখ চাষ করি। পরবর্তীতে তা গুড় তৈরির মহাজনদের কাছে বিক্রি করে দেই। পরে তারা শীতের সময় এসে সেই আখ থেকে গুড় তৈরি করে।
গুড়ের মহাজন আশরাফ আকন্দ বলেন, ‘আমি ১৯৯৯ সাল থেকে এই গুড়ের ব্যবসার সাথে আছি। বিগত বছর গুলো আমার জন্য অনেক ভালো ছিলো। বিশেষ করে ৯৯ সাল থেকে ২০০৮ ও ২০০৯ সাল ছিলো ভালো একটি সময়। এরপর ২০১৫ সাল পর্যন্ত মোটামুটি ব্যবসা হয়েছে। কারন এরমধ্যে চিনির একটি প্রভাব বাজারে পড়ার কারনে গুড়ের ব্যবসায় অনেক সমস্যা তৈরি হয়। আর বর্তমানে তো অনেক খারাপ অবস্থায় আছি। তারপরও আশা করি এ বছর ভালো কিছু মুনাফা পাবো। এ বছর টাঙ্গাইলের বিভিন্ন বাজারে ১ হাজার ৭শ’ থেকে ১ হাজার ৭৫০ টাকা প্রতি মন গুড় বিক্রি করছি। আশা করছি এ মৌসুমে প্রায় ১ হাজার কেজি গুড় উৎপাদন করতে পারবো।