কৃষি প্রযুক্তি

উন্নত জাতের পাট উৎপাদনে টিস্যু কালচার পদ্ধতি

পাট একটি নবায়নযোগ্য পরিবেশবান্ধব ফসল। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী কৃষিপণ্যগুলোর মধ্যে পাট অন্যতম। পাটের বীজ বপন থেকে আঁশ উৎপাদন পর্যন্ত ব্যবহৃত সব কিছুই দেশীয় সম্পদ। বিধায় পাট থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার সবটাই নিট মুনাফা। তাছাড়া পাটই একমাত্র ফসল, যা কৃষি এবং শিল্প উভয় ক্ষেত্রে লাখ লাখ মানুষের জীবিকার সংস্থান করে থাকে।

পাট Tiliaceae পরিবারের অন্তর্গত একটি উদ্ভিদ, যা পৃথিবীর খুবই কম দেশে আবাদ করা সম্ভব। বিশ্বে পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ২য় হলেও রপ্তানিতে ১ম স্থান দখল করে নিয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ পাটের ঐতিহ্য রক্ষার্থে পাটের প্রতি বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুনজরের কারণেই ক্রমাগত পাটের চাষ বেড়ে যাচ্ছে। দেশে বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ৮-৯ লাখ হেক্টর জমিতে পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের চাষ হয়ে থাকে। যা থেকে প্রায় ৮৫-৯০ লাখ বেল পাট উৎপাদন হয়। দেশের কৃষি জিডিপিতে পাটের অবদান ১.৪ শতাংশ; জিডিপিতে পাট খাতের অবদান ০.২৬ শতাংশ।

বাংলাদেশ বিশ্বের একমাত্র অধিক পরিমাণে কাঁচা পাট আঁশ রপ্তানিকারক দেশ। বাংলাদেশ বিশ্বের মোট পাটের ৩৩ শতাংশ উৎপাদন করে এবং কাঁচা পাটের ৯০ শতাংশ রপ্তানি করে। পাটের মাধ্যমে সোনার বাংলাদেশে পরিণত হতে দরকার উন্নত জাতের অধিক পাট উৎপাদন। টিস্যু কালচার পদ্ধতি যে কোনো উদ্ভিদের প্রজননে ও উন্নত জাত উদ্ভাবনে ব্যাপক সাফল্য নিয়ে এসেছে। উন্নত জাতের পাট উৎপাদনে টিস্যু কালচার পদ্ধতি ব্যবহারের বিকল্প নেই। এ পদ্ধতিতে উদ্ভিদের যে কোনো সজীব ক্ষুদ্রাংশ, যেমন- মূলের শেষভাগ, কাণ্ডের শেষভাগ, পাতা, পর্ব, পর্বমধ্য অথবা যে কোনো অংশের টিস্যুকে পরীক্ষাগারে জীবাণুমুক্ত পরিবেশে নির্দিষ্ট কৃত্রিম খাদ্য মিডিয়াতে কালচার করা হয়। কালচার করা টিস্যু থেকে অতি অল্প সময়ে, অল্প পরিসরে, উন্নতমানের প্রচুর সংখ্যক অনুচারা উৎপাদন করা যায়। উদ্ভিদ টিস্যু কালচারের পদ্ধতিটি একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে করা হয়। ফলে সারাবছর উদ্ভিদের চারা তৈরি অব্যাহত রাখা যায়।

উদ্ভিদের যে কোনো ক্ষুদ্রতম দৈহিক অংশ বা পৃথক কোনো টিস্যু টেস্টটিউবে বা যে কোনো পাত্রে কৃত্রিম মাধ্যমে লালন করে মাতৃ উদ্ভিদের মতো অবিকল নতুন চারা উৎপন্ন করার এ কৌশলের নাম প্রথমে দেওয়া হয় ক্ষুদ্র বংশবিস্তার। পরে আধুনিক বিজ্ঞানে প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের ফলে এতে কিছু নতুন প্রযুক্তি সংযুক্ত করে পরে এর নাম দেওয়া হয় টিস্যু কালচার। জার্মান উদ্ভিদ শারীরতত্ত্ববিদ হ্যাবারল্যান্ড ১৯৯২ সালে প্রথম টিস্যু কালচারের জৈবিক মূলনীতিগুলো বর্ণনা করেন। ১৯৯৩ সালে তিনজন বিজ্ঞানী নোবকোর্ট, গেদার হাট এবং হোয়াট কৃত্রিম জীবাণুমুক্ত মাধ্যমে ক্যালাস টিস্যুকে স্বতন্ত্রভাবে লালন করতে সমর্থ হন। কৃত্রিম বংশবিস্তার বা টিস্যু কালচার প্রক্রিয়ার উল্লেখযোগ্য সুবিধাজনক দিকটি হলো যেখানে একবীজপত্রী উদ্ভিদ সাধারণত বীজ ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে বংশ বৃদ্ধি ঘটানো যায় না; সেখানে এ পদ্ধতিতে খুব সহজেই এসব উদ্ভিদের বংশ বৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব।

স্ট্রবেরির মতো একটি ফল গাছের একটি একক কোষ বা টিস্যু বা ক্ষুদ্রতম কোনো অংশ থেকে বছরে প্রায় দুই মিলিয়ন চারা পাওয়া সম্ভব। তা ছাড়া টিস্যু কালচার পদ্ধতি উৎপন্ন চারার আকারে খুব ছোট হয়। স্বাভাবিক উৎপন্ন কলার চারার কথা বলা যায়। যেখানে এক হাজার কলার চারা পরিবহন করতে একটি বিশালাকার ট্রাকের প্রয়োজন, সেখানে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপন্ন এক হাজার চারাকে বহন করতে ছোট আকারে রিকশা-ভ্যানই যথেষ্ট। যার ফলে এ ধরনের চারা বহনে পরিবহন খাতে ব্যয় যথেষ্ট কম হয়। টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপন্ন চারা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় না। অপরপক্ষে এ প্রক্রিয়ার দ্বারা রোগ-জীবাণুমুক্ত ও বীজ উৎপাদনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে মাতৃ উদ্ভিদের শীর্ষস্থ ও পার্শ্বস্থ মেরিস্টেমেটিক টিস্যু হতে বীজ উৎপন্ন হয় বলে এতে ভাইরাসসহ অন্য রোগ-জীবাণু আক্রমণ কম হয়। প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও এসব বীজ থেকে চারা ও সুস্থ-সবল উদ্ভিদ জন্ম হয়।

আমেরিকা মহাদেশ আজ ‘বিশ্বের রুটির ঝুড়ি’ বলে খ্যাত যে কারণে তার প্রধান কারণ তাদের টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপন্ন বীজের ব্যবহার। কেননা এ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন গমের বীজ থেকে প্রচণ্ড নিম্ন তাপমাত্রায় স্বাভাবিকভাবে চারা ও পূর্ণাঙ্গ গাছ হয়। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এ ধরনের বীজ উৎপন্ন হলে তার মূল্যও কম হয়। তবে সে ক্ষেত্রে টিস্যু কালচার ল্যাব তৈরির খরচের পরিমাণ বিবেচ্য বিষয়ের মধ্যে আনতে হবে। আমাদের দেশে এ ধরনের একটি টিস্যু কালচার ল্যাব তৈরি করতে ১ কোটি হতে ১ দশমিক ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় হবে। এসব ল্যাবে মূল কাজ পরিচালনা করার জন্য দক্ষ জেনিটিক ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজন। যারা একটি সুস্থ সবল গাছের একটি অংশের মেরিস্টেমেটিক টিস্যু হতে কয়েক লাখ বিলিয়ন চারা উৎপন্ন করে। এ কাজ পরিচালনার পূর্বে পুরো দেহে জীবাণুনাশক মেখে নিতে হয়। প্রক্রিয়াটির চূড়ান্ত ফলাফল পাওয়ার জন্য কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হয়।

বর্তমানে চীন, জাপান, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বেশ কিছু দেশে বাণিজ্যিকভাবে টিস্যু কালচার ল্যাব হতে বীজ বা চারা উৎপন্ন করা হচ্ছে। জাপান, থাইল্যান্ড, এশিয়ার এ দুটি দেশ এ পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে প্রাপ্ত অর্কিড ও ফুল বিক্রি করে বিশ্ব বাজার থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিজেদের ঘরে তুলছে। এক জরিপে দেখা গেছে, হল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড টিস্যু কালচার পদ্ধতি প্রয়োগ করে যে আলুর বীজ উৎপন্ন করে তার প্রতিটির বীজের মূল্য পড়ে ১০ পয়সা, যা কি না সব উৎপাদন খরচের এক নগণ্য অংশ মাত্র; অথচ এ নগণ্য মূল্যের বীজ থেকে পরে তার সুস্থ-সবল আলু গাছ থেকে ফসলের সর্বোচ্চ ফলন পেয়ে থাকে। ১৯৫৪ সালে আলুর লেইট ব্লাইট রোগের কারণে আয়ারল্যান্ডে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, তাতে ৭-৮ লাখ লোক মারা গিয়েছিল। এতে তারা বুঝতে পারে, রোগ-জীবাণুমুক্ত বীজ সন্তোষজনক ফসল উৎপাদনের পূর্বশর্ত। তখন থেকে তারা টিস্যু কালচার পদ্ধতির উন্নয়নের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল এবং সফলও হয়েছে।

১৯৫৪ সালের দুর্ভিক্ষে শুধু আয়ারল্যান্ডই নয় গোটা উত্তর আমেরিকা সুস্থ বীজের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। তখন থেকে টিস্যু কালচারের প্রতি গুরুত্ব সহকারে নজর দিয়েছেন। যার ফলে আজ তারা কৃষি প্রধান দেশ না হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে। অনেক সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের দেশ কৃষি প্রধান হওয়া সত্ত্বেও এ পদ্ধতির ব্যবহারের শতকরা হার একেবারে কম। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক সূত্র থেকে জানা যায়, আমাদের দেশে মাদারীপুর হর্টিকালচার সেন্টারে দেশের প্রথম বাণিজ্যিক টিস্যু কালচার ল্যাবরেটরি তৈরি হয়েছে এবং এখান থেকে প্রায় ৪ লাখ কলা চারা ও কয়েক হাজার জারবেরা ও অর্কিড চারা তৈরি করে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। সুতরাং টিস্যু কালচার পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে অতি অল্প সময়ে, অল্প পরিসরে পাট ও পাট জাতীয় ফসল কেনাফ, মেস্তার রোগবালাইমুক্ত অধিক ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম হব।

লেখক: রত্না খাতুন, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সাইটোজেনেটিক্স শাখা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা